সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৯

প্রিয় তিশা!

শীতের এক মাখন রোদে, ভালোবাসার আবির ছড়াতে ছড়াতে আমার জীবনে এসেছিলে তুমি। যে ক'টি দিন আমার জীবনে ছিলে একছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছিলে। তোমার আগমনে হৃদয়ের কোথাও সুখ শঙ্খ বেঁজে উঠেছিলো, অন্ধকারে জ্বলে উঠেছিলো কয়েকশত জোনাকি , সেবার বসন্তে কোকিলের স্বর বেশী মধুর ছিলো, চন্দ্রমল্লিকার কড়া সু্বাস ছিল, শিকদার সাহেবের বাগানের ফুটন্ত গোলাপের পাঁপড়ি ও রং,মাধুর্য বেশী প্রকট ছিলো।
দিনভর ঝিরিঝিরি বৃষ্টির পর অবাক শান্ত সুন্দর আকাশটা দেখে তোমাকেই কেন জানি মনে পড়ে গেলো!

বিষন্ন মনে,ক্লান্ত বদনে লিখছি তোমায়। আজ সত্যি সত্যি জানতে ইচ্ছে করছে খুব কেমন আছো তুমি..??
বহু বছর হয়ে গেছে আমাদের কোনো যোগাযোগ হয়না।
তোমার আমার বন্ধুত্বও ছিলো যে এমনই অবাক সুন্দর। নিরালা দুপুরের মতো খামখেয়ালি হাসি গানে ভরপুর ছিলো আমাদের বন্ধুতের মুহূর্তরা।
রোজ বিকেলে দরজার চৌকাঠ পেরুতেই তোমার ছোট্ট বিনুনি ঝোলানো মিষ্টিমুখ,
কেমন অবাক মুগ্ধতায় মোড়ানো! বৃষ্টির পরের আকাশের মতোই তো,

আমি তখন মাদ্রাসায় পড়তাম আসা যাওয়ার দূরত্বের জন্য নিকটের স্কুলে এসে ভর্তি হোলাম...,, মাদ্রাসা থেকে আসার পর আমার রোল ছিল সবার শেষে ৬৮, তখন ছিলাম ক্লাস টুতে আমার এখনো মনে আছে মাত্র ২০ টাকা দিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম....প্রথম ক্লাসে একটু ভয় ভয় কাজ করলেও সবাই আমাকে চমকে দিয়ে সবার আপন করে নেয়।। পড়াশুনাই আমি আগে থেকেই অনেকটা ভাল ছিলাম তাই বন্ধু আর শিক্ষকদের মনে জায়গা করে নিলাম অল্পতেই......

যশোরে আমরা তখন নানুর বাড়িতে থাকতাম। ক্লাস শুরুর কিছুদিন পর তোমরাও তোমাদের নানুর বাড়িতে এসে উঠলে.. আর আমার সাথেই ক্লাস টু তে ভর্তি হলে... তুমি ছিলে পড়াশুনায় আমার থেকেও অনেক মেধাবি সেটা প্রথম সাময়িক পরিক্ষার পর বুঝতে পারি..কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে ওঠে..
দুজনে একসাথে স্কুলে যাওয়া একসাথে প্রাইভেট পড়া.একসাথে খেলাধুলা করা তখন অবশ্য জোলা বাতি আর পুতুলের বিয়ে এসব খেলাই বেশি খেলতাম..
তোমার সোনিয়া আপুর কথা মনে আছে যার কাছে আমরা প্রাইভেট পড়তাম....অনেক ভাল ছিলেন আপু আমাদের দুজনকেই খুব আদর করতেন..
দ্বিতীয় সাময়িক পরিক্ষায় দুজনের রেজাল্ট অনেক ভাল আসে!
কিন্তু বার্ষিক পরিক্ষা দেওয়া আর তোমার কপালে ছিল না তুমি সেদিন স্কুলে যাওনি আমাকে একাই চলে যেতে হয়েছে।
স্কুল ছুটির পর বাড়িতে এসে জানতে পারি "জোলা বাতি" খেলতে গিয়ে "বঠি" পরে তোমার পায়ের একটি রগ কাটা যায় আমি তখন তোমাকে দেখতে গিয়েছিলাম তোমার খাঁটে এভাবে ব্যান্ডিস পায়ে শুয়ে থাকতে দেখে আমার প্রচন্ড কান্না এসেছিলো জানো.....

তার কিছুদিন পর বার্ষিক পরিক্ষা ওও ঘনিয়ে গিয়েছে তোমার পায়ের এই অবস্থার কারণে আর পরিক্ষা দিতে পারোনি। তোমাকে ছাড়াই পরিক্ষায় অংশগ্রহণ  করতে হয় আমাকে এটা আমি কখনোই কল্পনাও করতে পারিনি.....
পরিক্ষার রেজাল্ট আসে আমি ৬৮ থেকে রোল ৪ এ নিয়ে আসি। আমার আত্মীয়  সজনরা সবাই খুব খুশি হয়েছিলো তবে আমি খুশি হতে পারিনি।
তুমি থাকলে হয়তো আমার থেকে ভাল করতে।
 তোমার সাথে প্রতিযোগিতায় আমি কখনোই জয়ী হতে পারতাম না......

আমি তোমার থেকে একটা ক্লাস উপরে উঠে গেলাম।
তৃতীয় শ্রেণিতে উঠে, ২য় পরিক্ষা দেওয়ার পর আমাকে চলে আসতে হয় আমার নিজ বাড়ি নোয়াখালীতে..
সবাইকে ছেড়ে তোমাকে ছেড়ে আসতে খুব কষ্ট হচ্ছিলো তবে কিছু করার ছিল না....
নোয়াখালীতে এসে পড়াশোনা নিয়ে অনেক ব্যস্ত হয়ে পড়ায় তার সাথে কোনো প্রকারের যোগাযোগ করার সুযোগ হয়ে উঠে নি..এর থেকে বড় কথা হলো যোগাযোগ করার মতো কোনো মাধ্যম তখন আমার জানা ছিল না, কিভাবে যোগাযোগ রাখতাম।
বাড়িতে আসার পর আরো অনেকবার যশোরে যাওয়া হয়েছে..  গিয়ে প্রথমে  তোমার খোজ করতাম  তবে  কখনো তোমার দেখা পাইনি...একবার শুনেছিলাম তোমরা নাকি নোয়াপাড়ায় থাক...

তিশা!
জীবনের কাছে আমরা প্রতিশ্রুত বলে পেরিয়ে এলাম সেই চৌকাঠ, সকালের মক্তব, পুকুর পাড়ের আঙ্গিনা।
আমরা না চাইলেও বড় হয়ে গেছি। আমাদের কাছে জীবনের এতো দায় যে আমরা ফেলে এসেছি সুখময় আকাশের পুরোটাই। জীবনের দায় মেটাতে মেটাতে  নিজের দায়টুকু আদায় করে নিতে ভুলে গেছি, তিশা। ভুলে গেছি হোমওয়ার্ক না করায় নিজের খাতায় অন্য নাম লিখে বন্ধুকে বাঁচিয়ে দেওয়ার অবাক বন্ধন, দৌড়াতে নেমে পিছিয়ে পড়লে গতি কমিয়ে জিতিয়ে দেবার আনন্দ। ভুলে যেতে যেতে কত কিছু ভুলে গেছি আমি! মনে আছে কেবল কয়েকটি শব্দ, কিছুমাত্র নাম। যেই নামগুলোতে জড়িয়ে ছিলো জগতের সবটুকু অকৃত্রিমতা।

তিশা!
আয়নায় দাঁড়িয়ে ভাবি, কতটা বড় হয়েছি আমরা! খুব কি বড় হতে পেরেছি!  অতোটা বড় হলে নিছক খেলারসাথীকে মনে রেখেছি কেন!? কেন আজো আটকে থাকি সেই শৈশবে?  তুমি কতটা বড় হয়েছ তিশা? যতটা বড় হলে কেউ অদূর অতীত ভুলে যেতে জানে, ততটাই বড় হও। মনে রাখা না ভুলে যাওয়া, কি বেশি সহজ আমি জানিনা। তবে এটা জানি যে মনের ভেতর স্মৃতি পুষে বাঁচা বড্ড কঠিন। সময় আমাদের থেকে হারায় না, তিশা। সে দিয়ে যায় স্মৃতির মস্ত লোকালয়।  কোনো নিভৃত রজনীর আঁধারে অবচেতন মনেই আমরা ঢুকে যাই সেই লোকালয়ে। হেঁটে হেঁটে দেখি কত কী বদলেছে এতদিনে!

আমি এখনো তেমনই, জানো? খুব শান্ত সমাহিত মানুষ। তবু মনে হয়, তোমাকে পেলেই ভীষণ বকবকিয়ে হয়ে যাবো। রঙিন জামা পড়ে হাত ধরে ঘুরবো আর গাইবো, আমাদের দেশটা স্বপ্নপূরী, সাথী মোদের ফুলপরী, লাল পরী নীল পরী.......
তিশা, হাসতে হাসতে পুতুল বিয়ে দিয়ে কেঁদে ফেলতাম আমরা। এরপর সহ্য করতে না পেরে দুজনেই বলে উঠতাম, আজকে এখানেই শেষ। আবার প্রথম থেকে খেলি চলো। মাঝেমাঝেই না খুব ইচ্ছে করে, আবার যদি শুরু করতে পারতাম জীবনটা, সেই প্রথম থেকে।
জন্মের সেই মুহূর্তটা থেকে, তবে আর বড় হতাম না কোনোদিন, যতটা বড় হলে তোমার আমার সন্ধ্যেরা পালিয়ে যায়। নর্দমার স্তুপে হারিয়ে যায় নিখাদ মায়াময় বিশাল আকাশের পুরোভাগ।
সেই শহরে চাপা পড়ে আছে দুটো কচি হৃদয়ের স্বচ্ছ আকাশ। এক ভালোবাসার বসতি। বেলা-অবেলায় প্রবহমান লাল নীল গল্পের জলাধার।

জানিনা তোমার আমাদের সেই ছোট বেলার বন্ধুত্বের কথা মনে আছে কিনা...
 তবে আমি ভুলিনি,, আজীবন মনে থাকবে আমার...
যদি কখনো দেখা হয় তাহলে কি চিনতে পারবে?? আগের মতো করে কি সেই ভালোবাসা টুকু থাকবে.??
আমার বিশ্বাস আরো বহু বছর পর হলেও আমাদের একবার দেখা হোক এতো বছরের জমে থাকা সব কথা মন উজাড় করে তোমাকে বলতে চাই..

ইতি,,
তোমার হারিয়ে যাওয়া ছোট্র বন্ধু (বাঁধন)